তখন রাতের দুই প্রহর।
উদাম আসমান। ফকফকা চান্নি। চান্নি দেখা যায়। তবে চান দেখা যায় না। ঘাড় বাঁকাতে হয়।
জলিবনমুখী কাঁচা রাস্তাটি ফসলী জমিন বেবচ্ছেদ করে কিছু দূর গিয়ে দুই দিকে দুই বাহু
মেলে দিয়েছে। বাহুর দুই মুঠিতে দুই গাঁও। যেন দুই সহোদরা। তাদের বোগল তলায় বিশাল ফসলী
মাঠ। রাস্তার সিথান বরাবর শিমুল গাছের আগায় এক কৌড়াল থেকে থেকে গর্জন করে-ক্রঁ...ক্রঁ...ক্রঁ!
সমস্ত আন্ধার চরাচরের বোবা স্তব্ধতাকে ফালি ফালি করে-চৌচির করে দেয়। মাটির গর্তে উড়চুঙ্গাও
দম ফেলে না। একটানা চিক্কুর পেড়ে কান্দে-উড়্...উড়্...উড়্!
রাস্তাটির পেট এফোঁড়-ওফোঁড়
করে বিদ্ধ হয়ে আছে যে কালভার্ট, কফিল তার উপরই দাঁড়িয়ে আছে একা। কালভার্টের খানিকটা
পিছনেই আধা মরা এক বিল। রাজ্যের জুনি পোকা এসে উৎসব জমিয়েছে এখানে। মনে হচ্ছে আজ শিয়ালের
শাদী। বিয়াশাদী তেনাদেরও হয়। বিয়াশাদী! কফিলের মনটা বিজলি দিয়া উঠে-আহা! ইমুন এক আলোর
উৎসবেই তো মহুয়ার শাদী অইয়া গেল-আমার জীবন থেইক্কা মহুয়া বেদখল অইয়া গেল চিরতরে!
কফিলের দিল- দরিয়ায়
নির্বোধ বৃত্তাকার, ভয়ংকর শূন্য চিৎকার উঠেছিল-কফিল! মহুয়া তোর বেদখল অইয়া যায়তাছে!
মহুয়াকে দখল কর!
কিন্তু পরক্ষণেই কল্পনার
জগতে মাকড়শার জাল বুনে কফিলের চিন্তা আটকে যায়। খালের পানির সামনে অবুঝ পশুর মতন আচমকা
কফিলের দুই পা মাটিতে পুঁতে যায়। ভয় না-আশঙ্কা না-এ বিশ্বাসের প্রশ্ন। বিশ্বাসের লোহার
বাসরে যে ষড়যন্ত্রের সুতানলী সাপ ঢুকে পড়েছিল!
একদিকে খুব হৈচৈ,
ঠিসি-টিপ্পনী, আনন্দধারা, নয়া জীবনের কৌতূহল আর অন্যদিকে এজিদের নিষ্ঠুরতায়-জয়নবের
চক্রন্তে কারবালার মাঠে খুব একা কেউ জবাই হয়ে গেল! গলাটা ফাঁক হয়ে গল্ গল্ করে নামল
রক্তধারা...।
মহুয়ার গোলাপদানা
মুখটা কফিল সেদিন দেখে নাই। উড়া উড়া শুনেছে সব বিত্তান্ত। হাসির ঝিলিকে নাকি মহুয়ার
টিকলি, নোলক, গজমতি হার, কানের দুল ঝলমলিয়ে উঠেছিল। সত্যিই কি মহুয়ার মুখখানা হাসিমাখা
ছিল? মহুয়া হাসতে পারে? বিছানা বদল করতে পারা কি এতই আনন্দের? সে নডিবেশ্যা তো নয়!
কালো কিছমিছ বোঁটা,
গতরের তাবিজ আর নাভির গোলক সাক্ষী রেখে মহুয়াকে তো পয়লা শাদী করেছিল কফিল। শুধু কাগুজে
চুক্তিপত্র ছিল না-এই তো!
ওরা প্রেম প্রীতির
পুণ্য বাঁধনে পরস্পরে নিমজ্জিত হয়েছিল। পরস্পরের বুকের ভিতর রচিত হয়েছিল সহজীবন-সহমরণের
চিরস্থায়ী অঙ্গীকারনামা। ভেঙ্গুরের কৌশলে মধুতে মধুতে গড়ে তুলেছিল অমৃতের গড়ল। মহুয়ার
ভাঙ্গা খাট তো ব্যাবাক কিছুর সাক্ষী। গিরায় গিরায় ক্যাঁৎ-কোঁৎ শব্দে জানিয়ে ছিল তার
অভিব্যাক্তি। তাছাড়া মহুয়ার কোমরে আর বুকে পিঠে আড় করে বান্ধা তাবিজ কি ভিতরে পুঁটলা
করা প্রণয়গাঁথা অস্বীকার করবে?
কফিলের লাগি রোববার
সন্ধ্যায় মহুয়ার বাড়ির গেইটে কেউ আর অপেক্ষা করে থাকে না। মহুয়া তার নয়া চুক্তিবদ্ধ
মানুষ লৈয়া রাত জাগে। কফিল এখন চেটের বাল আব্দুল্লাহ।
মহুয়া চেয়েছিল বিলাসী
জীবনের চিরস্থায়ী নিরাপত্তা বিধান। সে নিজে সরকারী লোক। আরেক সরকারী নাগর ছাড়া সমাজে
তার মান থাকে না। কিন্তু বাউল কিসিমের মানুষ কফিলের উপর তো সেই ভরসা করা যায় না।
কফিলের কোন আকার ছিল
না। পকেট সবসময় ফাঁকা। তবে বুকের পাঞ্জর কেটে চিরুনি বানিয়ে দেয়ার আকাঙ্ক্ষা তার ছিল।
সেই আকাঙ্ক্ষা নিয়েই কফিল বাজারি প্রেমের আন্ধাচক্করে পড়ে।
লাইলি মজনুর বিদায়ের
পালা...
শিরি ফরহাদের প্রেম
গোদামে মাইরাছে তালা...
দিন কাটে তার গান
লিখিয়া। ।
রাত তো কাটে না...
পিরিতির বাজার ভালো
না। ।
দিল দরিয়ার উত্তাল
ঢেউয়ে ঢেউয়ে রাতের তখন তিন প্রহর। বোতল বঞ্চিত মাতালের লাহান কফিল ছটফট করে। রাতের
এই অখন্ড নীরবতায় আচমকা ছোরা মারে ধান গাছের গোছির চিপায় ব্যাঙের আর্তনাদ-ফুঁয়াইৎ...ফুঁয়াইৎ...ফুঁয়াইৎ!
সাপের মুখে পড়ে ব্যাঙ তড়পায়। ব্যাঙের চিকন-তীব্র চিক্কুর কফিলের মন-মনুরায় বারি খেয়ে
দূর থেকে ভেসে আসা যাত্রাগানে মেলায়-
শোন তাজেল গো...
মন না জেনে প্রেমে
মইজো না...
মন না জেনে.. প্রেমে
মইজো না...
……………..
মইরা যাইয়াম এই তো! থু মারি এ জীবনে! হেঁডার জীবন! বারোডা
বাইজ্জা গ্যাছে বাঁইচ্চা থাকতে!
আগুনের আঁচে কাঁসার পাতিলের লাহান উত্তপ্ত কফিলুদ্দী
আনালে বিনালে রাগ ঝাড়ে।
কফিলুদ্দীরে চিনেন তো?...কি যে কন মিয়া ভাই, কফিলুদ্দীরে
চিনেন না! এ তল্লাটের বালক, নাবালক, যোবক থেকে প্রৌঢ় এক নামে চিনে তারে।
গপ্পের কথা না। আসলে সামনাসামনি তার আগুন-সুরত না দেখলে
সব বাকোয়াজি মনে হবে। একদিনের এক ঘটনা কই! তখন কফিলুদ্দী, আসমত আলী গেরস্থের বাড়ি বছর
থাকে। হঠাৎ গপসপের ভেতরে কথায় কথায় দুইজনে বাজি ধরে।
এই লাম্ব্যা আলুর জাবার মাথায় লৈয়া বাড়িত যাওয়া তো কোনো
ব্যাফার না।
কি কস! লৈয়া যাইতে পারলে সব আলু তর!
কইছেন তো?
হ, কইছি।
যেই কথা সেই কাম। শেষ পর্যন্ত দেড় কিলো পথ পাড়ি দিয়া
জাবার নিয়া গেছিল কফিলুদ্দী। বাড়িত নিয়া মেপে দেখে আলুর ওজন ছয় মণ! কফিলুদ্দী বাতাসের
বারিতে পত পত করে হেসে বলেছিল- আগে জানলে তো পথে জিরাইয়া লইতাম!
এই হচ্ছে কফিলুদ্দী। যৈবনে গায়ে-গতরে জৌলুস ছিল তার।
রাজ্যের বোঝা সে বহন করেছে। জীবনের পরতে পরতে জমা হয়েছে কত কেচ্ছা! কেচ্ছার পরতে পরতে
জমা হয়েছে কত কষ্টের মুখ!
সে তিনবেলা ভাতের নিরাপত্তার লাগি জিন্দেগিভর খাটাখাটনি
তো কম করে নাই। ইকটু ছায়া, ইকটু আলোর লাগি কি না করেছে সে! অথচ পুরো জীবন-যৈবন থেকে
রক্ত-পুঁজ-রস চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়েছে অনবরত। রৌদ্রের ভেতর, ছায়ার ভেতর, আলোর ভেতর থেকে
নাকে এসে ক্রমাগত লাত্থি মেড়েছে থেঁতলানো গন্ধ। মরা ডালে সামান্য বাতাসেই চড়ুইয়ের বাসার
মতন উড়ে যাই উড়ে যাই করছে তার সংসার।
তিক্তময় জীবনের এ পর্যায়ে এসে সম্মিলিত গভীর অস্থিরতায়
নিমজ্জিত হয়েছে কফিলুদ্দী। পুরো দেশ পড়েছে মরণ মারীর কবলে। দিনমান কফিলুদ্দী মৃত্যু
ও আক্রান্তের আকাশবাণী শুনে। শুনে সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ। শুনে সাবান-মাস্ক-হেন্ডগ্লাফস-হেক্সিসল-হেন্ড
সেনিটাইজারের কথা। এসব ছাতামাতা সে কিছুই দিশা করতে পারে না।
সে পেটের চিন্তায় তটস্থ। তার গায়ে-গতরে থিকথিকে ঘায়ের
মতন নোনতা-নোনতা ফেনায়িত কান্না জমে। ঘাড়ের পিছনে দুগোছা দড়ির মতন শিরা থর থর করে কাঁপে।
গলার ঘাড়ের আর মুখের মাংসপেশি টান টান করে বিজগী দিয়ে বলে- অত চুদুর-বুদুর করবার সময়
কই? আমরার চৌইদ্দ গুষ্ঠিতে কেউই অত সাবান চুদে নাই। আমরা কামলা মানুষ। গু-গোবর আতাই।
দিনমান সবান ঘইষ্যা আত দুইডা ফুলটুঙ্গিতে উডাইয়া রাখলে ফ্যাডে ভাত দিব ক্যাডা? ফ্যাডে
ভাত নাই ফিডে ইস্তারী!
কফিলুদ্দীর অনিদ্রা, দুশ্চিন্তা আর অনশনের ফলে গজিয়ে
ওঠা চোখের কোণের কালো দাগ আরও গভীর হয়, আরও চেতাইয়া উঠে। খালি অদৃশ্য আগুনে পট পট করে
পোড়তে থাকে সে। যে আগুনের শিখাসমূহ সুকৌশলে সূর্যালোকে মিশে গেছে। শুধু বাতাসের কাঁপন
বুঝা যায়। ঘড় পোড়ে-বন পোড়ে-পাখি পোড়ে-নদী পোড়ে-মানুষ পোড়ে। তবুও আগুন অদৃশ্য!
অজস্র নির্ঘুমের ভেতর সংসারের লগি টেনে চলা কলুর বলদ
কফিলুদ্দী ইন্দ্রজালিক ধান্ধাময়তায় আচানক খোয়াব দেখে- তামাম রাজ্যটাতেই কারবালা লেগে
গেছে; পানি নাই, খাদ্য নাই, দয়া নাই, মায়া নাই। চক্ষের সামনে শুধু সৈন্য-সামন্ত, মরা লাশ, দ্বিখন্ডিত
মাথা, গল্ গল্ রক্তস্রোত! মানুষের পিছনে ভয়ঙ্কর থাবা নিয়ে মৃত্যু ধাওয়া করে। আচমকা
মানুষ দৌড় ভুলে গিয়ে ডাঙ্গায় সাঁতার কাটতে থাকে। কূলকিনারাহীন আন্ধার সমুদ্রে হাত পা ছোঁড়ে। সাঁতার
কাটতে থাকে হাজার বছর ধরে। কিন্তু তাজ্জব ব্যাপার-
মানুষ এক সুতা আগাতে পারে না। সামনের ঘরগুলোকে
মনে হয় একেকটা ছোট ছোট নিরালা কবর।
কফিলুদ্দী আচমকা স্বপ্নজালের এক তন্তু থেকে আরেক তন্তুতে
নিজেকে আবিষ্কার করে। দেখে ফোরাতকূলে অসংখ্য মানুষ সাবান দিয়ে হাত ঘষে ঘষে পাখি হত্যা-নদী
হত্যা-বৃক্ষ হত্যা-মানুষ হত্যার রক্ত ধুয়ে ফেলার চেষ্টা করছে। কিন্তু কিছুতেই মুছে
ফেলতে পারছে না এ কলঙ্কের দাগ।
কফিলুদ্দীর খোয়াবের ঘোর আর কাটে না। প্রচণ্ড গোস্বা
আর ঘেন্না-জাগানিয়া-ঘোরের ভেতর বঞ্চিত জীবনের দিন গুজরান করে। পঁচা লাশের ঝাঁজ তার
নাকের পর্দা ছাড়িয়ে মগজের কোণায় কোণায় ঝিরঝির গন্ধ ছড়ায়। রক্তের নোনতা নোনতা গন্ধে
ভাবনাও ভিজে উঠে।
পাগলাকিসিমের কফিলুদ্দী অতিমারীর সতর্কতা বলতে দুনিয়া গয়রত করে আসা যোদ্ধের
প্রস্তুতিকে বুঝে। তাই সে নিজের ভাবনাকে নিজেই ঘষা দিতে দিতে বাঁশের কঞ্চির আগায় বল্লম
লাগায়, রামদা-কিরিচে শান দেয়। উলঙ্গ অলঙ্গার
ছোঁড়ে আনালে বিনালে।